সালটা বোধহয় ২০০৩। আমার তখন চাকরি সুত্রে লখনঊতে থাকা গিন্নী ও ছেলেদের নিয়ে। বাবা-মা বেড়াতে এসেছে আমাদের কাছে। গাড়ি নিয়ে কোথাও একটা বেড়াতে যাব। ঠিক হল কানপুর হয়ে চম্বলের বেহেড় পেরিয়ে যাব ঝাঁসী। যদিও এখন ঝাঁসী উত্তর প্রদেশের একটি জেলা শহর কিন্তু স্বাধীনতার আগে ছিল সেন্ট্রাল প্রভিনসের অংশ। জায়গাটা আমাদের দেখা ছিল না। মার কাছে কিন্তু যাওয়ার উদ্দেশ্য আলাদা। মায়ের জন্মস্থান হল ঝাঁসী। যদিও ১৯৩৮ সালে। খুব ছোটবেলায় ঝাঁসী ছেড়ে এসেছে দাদুর বদলির জন্য। কিন্তু জন্মস্থান বলে কথা; তার আকর্ষন আলাদা। সঙ্গে দেখবো ওরছা এবং গওয়ালিয়র।
যাই হোক, দুর্গা দুর্গা বলে এক রবিবার সকাল সকাল রওনা হলাম ঝাঁসীর দিকে। দুপুরে রাস্তায় খাওয়া দাওয়া করে সূর্যাস্তের আগেই পৌছলাম সেখানে এবং রানী লক্ষ্মীবাই হোটেলে উঠলাম। পরদিন ঝাঁসীর যাবতীয় দর্শনীয় স্থানগুলি যেমন কেল্লা, মন্দির, ওরছা ইত্যাদি দেখা হল।
বিকেলে মার কাছে জিজ্ঞাসা করলাম যে মা ছোটবেলায় কোন যায়গায় ছিল। মার কাছে বিশেষ একটা জবাব পেলাম না। শুধু জানলাম যে মা যে বাড়িতে ভাড়া ছিল তার মালিক ছিল ডাঃ গুলাঠি। রাস্তার নাম আবোট রোড আর বাড়ির কাছে একটা সিনেমা হল ছিল আবোট সিনেমা। এর বাইরে কিছু উদ্ধার করতে পারলাম না।
আমি, বাবা ও আমার গিন্নী মিলে ঠিক করলাম যে ফেলুদা কিংবা ব্যোমকেশ হওয়ার চেষ্টা করি কারণ পরদিন আমরা মোটামুটি ফাঁকা ছিলাম। কিন্তু কোথা থেকে শুরু করব? সুত্র তো কিছুই পারছি না তার কারণ স্থানীয় কেউ এমনকি হোটেলের লোকও বলতে পারছে না ওই নামে কোনও রাস্তা বা সিনেমা আছে কিনা। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাড়াল। কিন্তু সঙ্গে গাড়ি আছে, তাই “হাল ছেডোনা বন্ধু” বলে আমরা সবাই মিলে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে লাগলাম যদি কোন সুত্র পাওয়া যায়। রাস্তায় কোনও বয়স্ক লোক দেখলেই তাকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলাম। এই করতে করতে বেলা দশটা বেজে গেল। কিছুটা হতাশ হয়ে সদর বাজারের কাছে একটা চায়ের দোকানে দাড়িয়ে নিজেদের চাঙ্গা করার চেষ্টা করলাম।
হঠাত্ চোখে পড়ল রাস্তার বিপরীত দিকে একটা বন্ধ দোকান যেখানে লেখা আছে “ডক্টর্স ক্লিনিক” আর ডাঃ নীনা গুলাঠি এবং ডাঃ মহেশ চন্দ্র। নিরাশার মাঝে এক ক্ষীণ আশা জেগে উঠল। মা তখন গাড়িতে বসে।
মা, তোমাদের বাড়ীওয়ালা ডাঃ গুলাঠীর কি কোনও মেয়ে ছিল?
হা, তিন মেয়ে। জয়া, নীনা আর ছুটকি।
মনে হল বোধহয় কোনও সুত্র পেয়েছি। কিন্তু তাও সন্দেহ রয়ে গেল কারণ পৃথিবীতে তো একটা নীনা গুলাঠি নেই। তার ওপর দোকান তো বন্ধ। পাশের একটি রেডিয়ো টিভি সারানোর দোকান তখন খুলে গেছে। অগত্যা তার শরণাপন্ন হতে হল জানতে ডাক্তারের চেম্বার কখন খুলবে। জানলাম সাধারণত: এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে খোলে। ঘড়িতে দেখলাম বেশি দেরি নেই। কাজেই অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই ডাক্তার মহিলা গাড়ি থেকে নামলেন। সঙ্গে চালক নেমে চেম্বারের তালা খুলে দিল। একটু অপেক্ষা করলাম কারণ আমরা তো রুগী নিয়ে আসিনি, এসেছি অনুসন্ধান করতে।
একটু বাদে গুটি গুটি পায়ে মহিলাকে সম্ভাষণ করে বললাম যে আমার মা কলকাতা থেকে এসেছে আপনার সঙ্গে দেখা করতে, তাকে কী নিয়ে আসবো? ভাগ্যিস কোন রুগী ছিল না, নাহলে বিপদে পড়তাম। গিন্নী গিয়ে মাকে নিয়ে এল। আমি বাক্যালাপ শুরু করলাম।
আপনার বাবা কী ডাঃ গুলাঠি? – হা, কিন্তু উনি তো অনেক দিন মারা গেছেন।
আপনার দিদির নাম কী জয়া আর বোন ছুটকি? –হা বলে আশ্চর্য হয়ে আমাদের দিকে তাকালেন। কিন্তু কী ব্যাপার? এত কিছু জিজ্ঞাসা করছেন কেন?
এবার আমি কাহিনীর অবতারণা করলাম। মা আপনাদের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন জন্ম থেকে ১৯৪৪ পর্যন্ত। তারপর মা যে সব টুকরো নাম বলেছে সেগুলো বলতে জানতে পারলাম যে আবোট রোড হয়ে গেছে শহীদ ভগত সিংহ মার্গ, আবোট সিনেমা হয়ে গিয়েছিল কৃষ্ণ সিনেমা তাও বহু দিন বন্ধ হয়ে গেছে। পাশেই রামলীলা মাঠের কথা বলায় মার মনে পড়ে গেল। এও জানা গেল যে বাবার মৃত্যুর পর ওই বাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে আর বর্তমানে ওই বাড়ি কিনেছে কোনও এক ডাঃ আগরবাল। তার মা এখন আছে দিদির কাছে জয়পুরে আর ছোট বোন থাকে বেনারস শহরে। ওনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এলাম।
মধ্যাহ্নভোজনের পর আমাদের দ্বিতীয় পর্যায়ের অভিযান শুরু। শেষ পর্যন্ত রাস্তা খুজে পেলাম আর তারপর সেই বাড়ি। বিরাট জমি নিয়ে বাংলো বাড়ি। বাড়িতে ঢুকেই মার চোখে জল এসে গেল কারণ এই খুজে পাওয়ার আনন্দ যাদের সঙ্গে ভাগ করে নেবে তারা কেউ আর পৃথিবীতে নেই। পরিচয় দিতেই ডাঃ আগরবালের পরিবার আমাদের পরম আতিথেয়তার সঙ্গে ঘরে ডেকে নিলেন।তারপর চা এবং অন্যান্য খাদ্য দিয়ে গল্প করতে বসলেন। যদিও ডাক্তারবাবু নিজে ছিলেন না তবু তার পরিবার আমাদের নিয়ে বাড়িটা দেখাতে বেরোলেন। মা তখন তার বয়স ভুলে শৈশবে ফিরে গেছে। কোথায় বসার ঘর, শোবার ঘর, রান্নাঘর ইত্যাদি আমাদের দেখাতে লাগলো। যদিও কিছু রদবদল হয়েছে তবু বাড়ি সেই রয়ে গেছে।
মা তাদের জিজ্ঞাসা করল যে একটা বড় ইঁদারা ছিল সেটা কী আছে? আমাদের বলল যে তাদের একটা চাকর ছিল লালা বলে সে একবার ইঁদারাতে পড়ে গিয়েছিল আর তাকে বালতি করে তোলা হয়েছিল। সেই ইঁদারা এখনো আছে তবে বালতির বদলে পাম্প হয়েছে। বাড়ির গৃহিনী মাকে জিজ্ঞাসা করল যে মা কিভাবে লালাকে চেনে। জানা গেল বাড়ি হাত বদল হলেও লালা ওই বাড়িতে রয়ে যায় এবং মাত্র দুই বছর আগে বয়সজনিত কারণে লালা দেশের বাড়িতে ফিরে যায়। বর্তমানে তার নাতি ওই জায়গায় আছে। তার সঙ্গেও পরিচয় হল। সেই পরিবারকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম।
মার কাছে এ যেন সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাক আর আমাদের কাছে এটা গোয়েন্দার রহস্য উন্মোচন। হোটেলে ফিরে মনে হল যেন ঝাঁসীর কেল্লা জয় করে ফিরেছি।
আজ মা এবং বাবা দুজনেই নেই। তবু মনে হয় মার যে সুপ্ত বাসনা ছিল অতীতে ফিরে যাওয়ার সেটা সফল করতে পেরেছিলাম সেটাই ছিল এই সফরের সবচেয়ে বড় পাওনা। যদিও পরদিন আমরা গওয়ালিয়র উদ্দেশ্যে রওনা হলাম এবং অনেক ঐতিহাসিক স্থান দেখা হল কিন্তু ওই বেড়ানোর সবচেয়ে সুন্দর ও ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্য ছিল মায়ের জন্মস্থান।
Photo Jhansi Fort Courtesy Google
অপুর্ব লেখ। ভীষণ ভালো লাগলো পড়ে। Very neat, beautifully composed. You are a good story teller. I would like to see more of your writings.
ReplyDeleteভাল লাগল জেনে খুব আনন্দ পেলাম। লকডাউনে বন্দী হয়ে জীবনের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলাম
Deleteখুব ভালো লেখা । চালিয়ে যাও বন্ধু
ReplyDeleteধন্যবাদ। মতামত আমাকে আরও লিখতে অনুপ্রাণিত করবে
Deleteদাদা, প্রথমেই মাসীমা মেশোমশাইকে প্রণাম জানাই। প্রথম থেকে এই লেখাটা পড়তে পড়তে থ্রিলার উপন্যাসের অনুভূতি আসছিল। শেষ পর্যন্ত মাসীমা তাঁর জন্মভূমি পৌঁছতে পেরেছিলেন দেখে স্বস্তি পেলাম। অসাধারণ লেখনী। আপনি আমাদের সমৃদ্ধ করছেন।
ReplyDeleteধন্যবাদ। জায়গাটা খুঁজে বার করা আমাদের কাছে একটা challenge ছিল। মায়ের আশা মে সফল করতে পেরেছি এটাই আমার সাফল্য।
Delete